জাতীয়

মহিউদ্দিন রনির ৬ দফার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে

রেলের অনিয়ম জালিয়াতি

ডেস্ক রিপোর্টঃ

রেলের অব্যবস্থাপনা ও টিকিট নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। ঈদ এলেই অব্যবস্থাপনা চিত্র নতুন করে সামনে আসছে। এবার ঈদে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে এবং সেটি হচ্ছে শিকল পরা ঢাবি ছাত্র মহিউদ্দিন রনির ব্যতিক্রমী আন্দোলন কর্মসূচি। ঈদের দিন থেকে রেলের টিকিট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ৬ দফা দাবিতে সোচ্চার তিনি।

রনির আন্দোলন যে যৌক্তিক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রায়ের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত। রনির এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তার ৬ দফার সমর্থনে আন্দোলন হয়েছে বা হচ্ছে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, নোয়াখালী, সিলেট ও চুয়াডাঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পাশাপাশি অনলাইনে টিকিট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত সহজ ডটকমের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগও নতুন নয়।

এর আগে অনলাইনে কারসাজি করে একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টিকিট কালোবাজারির কারণে সহজের একজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাকে বরখাস্তও করা হয়। এবার রনির সঙ্গে টিকিট জালিয়াতির কারণে সহজকে দুই লাখ টাকা জরিমান করা হলো। রেলের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে পড় জরিমানার অঙ্ক। তবে রনিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার তাকে কমলাপুর স্টেশন থেকে বের করে দেওয়া হলেও শুক্রবার তিনি আবার স্টেশনে গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বিষয়টি আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে। তবে গত এক দশকে রেলকে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তার সুফল জনগণ এখনো সেভাবে পাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে রেলের বদলে যাওয়ার সেই পুরোনো স্লোগানই দেওয়া হচ্ছে।

এ নিয়ে শুক্রবার কথা হয় রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রনি যে স্মারকলিপি দিয়েছেন তার জবাব রেলওয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। আদালত থেকে যে বিষয়গুলো চাওয়া হয়েছে, সেগুলোও আমলে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আমি বলতে যাই, রেলে যে উন্নয়ন হচ্ছে-সেগুলো সমাপ্ত হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। যাত্রীদের চাহিদা অনেক বেশি, আমরা দিন দিন অবকাঠামো বাড়িয়ে ট্রেনের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করছি। আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিই না। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে।

এদিকে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ জানতে চেয়েছে। রনির অভিযোগ তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও আদালতকে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এদিকে বৃহস্পতিবার রনিকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়। পরে তিনি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেন।

বেশ কিছু সময় সেখানে অবস্থানের পর শুক্রবার কয়েকজনকে নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে ছুটে যান। তবে তাকে ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ায় তিনি স্টেশনের বাইরে যাত্রীছাউনিতে বসেই প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যান। শুক্রবার বিকালে রেলওয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুগান্তরকে বলেন, ‘রনিসহ তার সঙ্গীদের কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।’

রনির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে শুক্রবার অনেকেই কমলাপুরে ছুটে গেছেন। শুক্রবার সকালে রেলওয়ে স্টেশন থেকে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ফেসবুক পেইজে রনির পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরাসরি লাইভ করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় কথা হয় ব্যারিস্টার সুমনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি চরমে উঠেছে।

সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত সেই অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন। শুধু রনি নয়, রনির মতো এমন হাজারো মানুষ রেলের অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন। অনিয়ম-দুর্নীতি বাড়ছে, অথচ রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ বিভাগের দায়িত্বের থাকা কর্মকর্তারা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন অসভ্যতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ জেগে উঠবেনই।

শুক্রবার কথা হয় রনির সঙ্গে থাকা ঢাবি শিক্ষার্থী জিয়াউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি চট্টগ্রামে। শুক্রবার ট্রেনে করেই চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্টেশনে এসে সোনার বাংলা এবং তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনের কোনো টিকিটই পাইনি। জীবনে বহুবার টিকিট কাটা নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছি। কালোবাজারিদের কাছ থেকে ২-৩ গুণ বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চট্টগ্রাম-ঢাকা আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ আর রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি।

গত ১৯ জুলাই দুপুরে রেলের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারকে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিরসনে ৬ দফা দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেন রনি। তিনি বলেন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানের সময় স্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর সদস্যরা তাকে নানাভাবে হেনস্তা করেছেন। কেউ কেউ কর্মসূচি বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

১৮ জুলাই রেলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশনে ৭ শিক্ষার্থী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। তারা রনির ৬ দফার প্রতি একাত্মতা জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্লোগান দেন। এছাড়া দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় জাগ্রত সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্যরা। এ সময় এ কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করে।

সংস্থাটির সভাপ?তি আফসানা ইমরোজ জানিয়েছেন, রেলের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মহিউদ্দিন রনির সঙ্গে তারা একাত্মতা ঘোষণা করে দিনাজপুরেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। একই ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। রনির আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচি পালিত হয়েছে ঈশ্বরদী, সিলেট ও নোয়াখালীতেও।

শুক্রবার সন্ধ্যায় কথা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘কমলাপুর স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করে। কাউন্টার এলাকা কিংবা প্ল্যাটফরমে এমন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এমনটা করতে দেওয়া যায় না।

স্মারকলিপির দাবির বিষয়ে তিনি (রনি) বলেছেন, বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করতে। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ যাত্রী ট্রেনে চলে, একটি করে পানির বোতল দিতে গেলে প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। স্মারকলিপিতে উঠে আসা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্সে আসি। দুদকে অনেকগুলো মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলমান রয়েছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে কোচ-ইঞ্জিন। যাত্রীসেবা বাড়াতে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্প। যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পও গ্রহণ করা হচ্ছে।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফরমে শুক্রবার সন্ধ্যায় বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী একরামুল হক আবির জানান, রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে চার দিন ধরে তারা দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফরমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দিনাজপুরে নতুন ৬ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ রেলওয়েতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৪ থেকে ২০তম গ্রেডের পদে ৮০ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ১০ শতাংশ কোটায় নামিয়ে আনতে হবে, উত্তরবঙ্গে ডাবল লেন সংযুক্ত করার পাশাপাশি ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও যাত্রীসেবার জন্য বগির সংখ্যা বাড়াতে হবে, টিকিট কাউন্টারে সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিদিন একই ব্যক্তি হিসাবে যারা টিকিট ক্রয় করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে, ট্রেনের আসন সংখ্যা সম্পন্ন হওয়ার পর প্রদানকৃত স্ট্যান্ড টিকিটের মূল্য অর্ধেক করতে হবে, চাকরিপ্রত্যাশী লাখো বেকারের কথা ভেবে নিয়োগ পরীক্ষার্থীদের ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এডমিট কার্ড প্রদর্শনপূর্বক অর্ধেক ভাড়ার নিয়ম চালু করতে হবে।

রনির ৬ দফা : টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সহজ ডটকম কর্তৃক যাত্রী হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। হয়রানির ঘটনায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ করতে হবে। অনলাইনে কোটায় টিকিট ব্লক করা বা বুক করা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে অনলাইন-অফলাইনে টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

যাত্রী চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কসহ অন্যান্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর, শক্তিশালী তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রেলসেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে। ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার বিক্রি, বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

Related Articles

Back to top button