কক্সবাজারসারাদেশ
Trending

কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে পাহাড়ি ভূমির সাথে সমন্বয়ের অসামঞ্জস্যতা : ভারি বৃষ্টিপাতে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশংকা

ডেস্ক নিউজ
গত ৭ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ভারী বর্ষণ,পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। ভূমিধস ও পানিতে ডুবে মারা যান ২০ জন।এর ফলে জেলার আর্থীক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৬২১ কোটি ৯১ লাখ ৭৭ হাজার টাকার। যার অধিকাংশই কক্সবাজারের চকরিয়া,ঈদগাও,রামু ও পেকুয়া উপজেলায়। যাতায়তের সুবিধায় পাহাড়ি ভূমির সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি করা হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। এ সমন্বয়ের কারণে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যায় মহাসড়কের যেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, তেমনি মহাসড়ক বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণও হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে পাহাড়ি ভূমির সঙ্গে রেলপথের সমন্বয়ে যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রেলপথটির জন্য যে সড়কবাঁধ তৈরি করা হয়েছে, তার উচ্চতা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চেয়েও বেশি। স্থানীয়দের দাবি সত্ত্বেও রেলপথটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সেতু-কালভার্ট রাখেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সেতু-কালভার্টের গঠন এবং এসব কাঠামোয় পানি প্রবেশের ‘‌ক্যাচমেন্ট এরিয়া’ নির্মাণ যথাযথ হয়নি বলে দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন কারিগরি ও নকশাগত ত্রুটির কারণেই আগস্টের প্রথম সপ্তাহের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ রেলপথ। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে রেলপথটি আরো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা বা জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড় ও বনাঞ্চল বেষ্টিত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বন্যা হলেও তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে যে বন্যা হয়, তা ছিল এ অঞ্চলের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী। এ বন্যায় সদ্য নির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মুখে পড়েন এখানকার মানুষ। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি ও ক্ষেতের ফসল। পাহাড়ি এলাকায় বন্যা বা জলাবদ্ধতা দ্রুত নিষ্কাশন হওয়ার কথা থাকলেও রেলপথের উঁচু বাঁধ বন্যার পানি নামার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করেছে, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
অভিযোগ সম্পর্কে একমত স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও। সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘রেলপথটির জন্য যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তার দুই পাশে পানি প্রবাহের জন্য যেসব কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো দিয়ে নদ-নদী থেকে উপচে পড়া পানি কোন পথে নির্গমন হবে সে ব্যবস্থা করা হয়নি। এ কারণে পানি নিজ গতিতে ভিন্ন ধারায় নিম্নগামী হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে রেলপথসংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার অন্যতম কারণ।’ রেলপথে কালভার্ট বা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে পানি চলাচলের পথ নির্মাণ করলেও এসব কাঠামোয় পানি প্রবেশের ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্মাণসহ বিভিন্ন কারিগরি কাজের ত্রুটি রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১৩-১৪ সালে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, কৃষক, জেলেসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠী, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, উপকূলীয় বনবিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তবে এসব বৈঠকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সম্পৃক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষার সময় বন্যার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় অংশীজনরাও। তাদের মতামত সমীক্ষা প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা হলেও স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে তাদের পরামর্শ আমলে নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর ঢেঁমশা এলাকার বাসিন্দা ও কেরানীহাট বাজারের ব্যবসায়ী আবুল কাশেম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রেলপথ নির্মাণ করার আগে আমরা এ এলাকায় সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে সেতুর বদলে দেয়া হয়েছে কালভার্ট। এর ফল আমরা হাতেনাতে ভোগ করছি। বন্যা তো পার করে ফেলেছি। এখন একটু বৃষ্টি হলেই এলাকায় পানি জমে যায়। ভারি বৃষ্টিপাত হলে হয়তো আবার দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেবে।’ কেঁউচিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, ‘রেলপথটি অনেক উঁচু করা হলেও কালভার্টগুলো খুবই ছোট। জমিতে পানি জমলে আগে দ্রুত পার্শ্ববর্তী খাল ও নদীতে চলে যেত। কিন্তু এখন পানি বের হওয়ার পথ পাচ্ছে না। রেলপথের বাঁধ তৈরি করার পর থেকেই আশপাশের গ্রামগুলোয় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।’
যদিও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে স্থানীয়দের দাবির মুখে কালভার্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, নকশা অনুযায়ী পুরো রেলপথে ১৪৪টি কালভার্ট হওয়ার কথা। কিন্তু স্থানীয়দের দাবির মুখে কালভার্টের সংখ্যা ১৭৩টি করা হয়েছে। বর্তমানে কালভার্টের সংখ্যা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমে স্থানীয়দের দাবির মুখে সেতু-কালভার্টের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পরবর্তী সময়ে বন্যায় রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আরো সেতু-কালভার্ট নির্মাণের পরিকল্পনা এটাই প্রমাণ করে যে প্রকল্পের নকশাগত ও কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষাগুলো যথাযথ ও সমন্বিতভাবে করা হয়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সমান্তরালে যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক রয়েছে, সেই মহাসড়কের কারণে কিন্তু এমন বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এখন রেলপথ তৈরি করার পর সমস্যা হচ্ছে। এ রেলপথটিতে কালভার্টের যে স্বল্পতা রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যথাযথ সমীক্ষার মধ্য দিয়ে যে সংখ্যক কালভার্ট প্রয়োজন এবং কালভার্টের যে ডাইমেনশন প্রয়োজন, দুটোই যদি সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।’
পানি প্রবাহের জন্য যে সমীক্ষা করা দরকার, তা নিবিড়ভাবে না করার কারণেই এমনটি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‌চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার ভূমির কাঠামো কিন্তু আলাদা। সাধারণত বাংলাদেশে পানি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রবাহিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় পানির প্রবাহ পূর্ব-পশ্চিমমুখী। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় বৃষ্টিপাতের যে রেকর্ড এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে সমন্বিতভাবে সমীক্ষা করে তারপর রেলপথটি তৈরির কাজ হাতে নেয়া উচিত ছিল।’
তবে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলছেন, যথাযথভাবে সমীক্ষা করেই দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় যে বন্যা হয়েছে, তা স্মরণকালের মধ্যে দেখা যায়নি। এ বন্যার সঙ্গে রেলপথের কোনো সম্পর্ক নেই। বন্যায় রেলপথ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা এরই মধ্যে আমরা ঠিক করে ফেলেছি।’ বন্যার সঙ্গে রেল পথের সংশ্লিষ্টতা এবং ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। আগামী অক্টোবরের শেষ নাগাদ দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটি চালু করে দেয়া হবে উল্লেখ করে নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলপথটিতে অক্টোবরের ১৫ তারিখ নাগাদ পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হবে। আর অক্টোবরের শেষ নাগাদ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন বলে আমরা আশা করছি।’ স্থানীয়রা বলছেন, সাম্প্রতিক বন্যা ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রেলপথ সংলগ্ন এলাকাগুলোয় পানি জমে থাকার হার বেড়েছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, দোহাজারী, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, কক্সবাজারের চকরিয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এ রেলপথ নির্মাণের জন্য বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের একাধিক পাহাড়ও কাটা হয়েছে। এসবের প্রভাবে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও করছেন পরিবেশবিদরা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. মো. মহসিনুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ‌বায়োলজিক্যাল এনভায়রনমেন্ট নিয়ে আলাদা একটা স্টাডি দরকার। কিন্তু আমাদের কোনো প্রজেক্টে এটা করা হয় না। এখানে যেকোনো উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের ক্ষতি অবশ্যই হবে। কিন্তু এ ক্ষতির মাত্রা কত তা কিন্তু আমরা জানি না। যেটা প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নেই উঠে আসার কথা। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে হাতি চলাচলের জন্য কিছু পথ করে দিয়েছে। কিন্তু হাতি কি সারা বছর ওই একটি করিডোর দিয়েই যায়? এটা কিন্তু আমরা জানি না। প্রত্যেকটা কাজের জন্য পরিবেশ নিয়ে আলাদা স্টাডি দরকার, যেটা আমাদের দেশে হচ্ছে না। যার কারণে এ ধরনের সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সব জায়গায় মানুষ আছে। সব জায়গায় উন্নয়ন হচ্ছে। এটা কিন্তু আমরা একটা ভুল নীতির দিকে যাচ্ছি। আমাদের রাস্তাঘাট, রেলপথ দরকার আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখা।’ দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের যে অংশগুলো নিয়ে বন্যপ্রাণী চলাচলের পথ, বনাঞ্চল এবং যেসব এলাকায় বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়, সেগুলোয় এলিভেটেড (উড়ালপথ) করে দেয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Related Articles

Back to top button