ধর্ম ও জীবনসাহিত্য

জাতীয় কবি নজরুলের কবিতায় ঈদুল আজহা

কোরবানি নিয়ে রুহু জাগানিয়া অনেক কবিতা লিখেছেন মানবতাবাদী-অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ভোগ-বিলাসে মত্ত মুসলমানদের ইবরাহিমি চেতনায় ও ত্যাগে জেগে ওঠার সবক পাওয়া যায় নজরুলেরর বিভিন্ন কবিতায়।

পাপ-পঙ্কিলতায়, লোভ-লালসায় জর্জরিত বিশ্ব মুসলমানকে নজরুল বারবার বলেছেন, বনের পশু নয়- মনের পশুত্বকে কোরবানি করে শুদ্ধ মানুষ হওয়ার সাধনা কর। শুদ্ধ হওয়ার সাধনা করাই হল নবী-রাসূলদের শেখানো সত্যিকারের কোরবানি।

কোরআনে যে কোরবানির আদেশ দেয়া হয়েছে, নজরুল সে কোরবানির কথাই বলেছেন ছন্দে ছন্দে- ‘ইবরাহিমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?/আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু-ছাগ?/আল্লার নামে ধর্মের নামে, মানবজাতির লাগি/পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?/সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম কর তারে,/ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।/অন্তরে ভোগী বাইরে সে যোগী, মুসলমান সে নয়/চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়।’

শুধু পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়। এটি এক অবাস্তব কল্পনা। এটি নজরুলের মনগড়া কথা নয়। কোরআনে বলা আল্লাহর ফরমান। সূরা হজের ৩৭নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘লাইয়্যা নালাল্লাহা লুহুমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়ালা কিন ইয়ানা‘লুহুত তাকওয়া মিনকুম- তোমাদের জবাই করা পশুর রক্ত-মাংসের দিকে আল্লাহ ফিরেও তাকান না, তিনি দেখেন তোমাদের মনের তাকওয়া।’

কোরবানির শিক্ষা হল, মনের পশুকে জবেহ করে নিজেকে খোদায়ী রঙে সাজিয়ে তোলা। সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা ও অধর্মের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে গর্জে ওঠা। এমন মুসলমানদেরই কোরআনে জীবন্ত শহীদ বলা হয়েছে।

ঈদুল আজহা আত্মত্যাগে ডুবে যাওয়ার দিন। আজহা মানে প্রভাতের ঝিলিমিলি আলো, যা অন্ধকার দূর করে দেয়। রাতের আধার ভেঙে নতুন সকাল নিয়ে আসে। কিন্তু যে মুসলমান আত্মপূজায় ডুবে আছে সে কীভাবে অন্যকে আলোকিত করবে? তার আত্মা তো স্বার্থের কালোয় কলুষিত।

নজরুল বলেছেন, মুসলমানের দায়িত্ব হল বিদ্বেষমুক্ত প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলা। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি আত্মপূজা এবং স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ন্যায়-ইনসাফ-সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবে না। স্বার্থপরের জন্য জান্নাত হারাম। নজরুল বলেছেন, ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে/মুসলিম নহে ভণ্ড সে/ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/দাও কোরবানি জান ও মাল/বেহেশত তোমার কর হালাল/স্বার্থপরের বেহেশত নেই।’

যারা স্বার্থপর তাদের কোরবানি-নামাজ-রোজা সবকিছু লোকদেখানো ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। নজরুল এদের সেরা বে-দিন, শ্রেষ্ঠ কাফের বলেছেন। নজরুল বলেছেন, তোমরা ইসলামকে কবর দিয়ে আবার নিজেদের মুসলিম বলে গর্ব করছ! আরে, তোমাদের মতো পোশাকি ধার্মিক, লোকদেখানো কোরবানিদাতারাই তো ইসলামের গলায় ছুরি বসিয়ে ইসলাম নামের শান্তি ও মুক্তির নৌকাটিকে ডুবিয়ে ফেলেছ। তারপর নজরুল বলেছেন, ‘নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং,/ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং,/ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম!/কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়,/ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!/তোর নামাজের কি আছে দাম?’

এসব লোকদেখানো কোরবানিদাতা, স্বার্থপর মুসলমান ও পোশাকি ধার্মিকদের নজরুল নসিহত করে বলেছেন, বনের পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে নিজেকে মানুষ বানিয়ে নাও। মানুষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার কোরবানি কীভাবে কবুল হবে আল্লাহর কাছে! ভেতর জগতে তুমিও একজন পশু, ওই অবলা জানোয়ারটিও পশু। এক পশুকে আরেক পশু কোরবানি দেয়া কি হাস্যকর নয়!

শেষ করছি নজরুলের কবিতা দিয়ে, ‘পশু কোরবানি দিস তখন/আজাদমুক্ত হবি যখন/জুল্মমুক্ত হবে রে দ্বীন।’ হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ভেতরকে নবুয়াতি রঙে, কোরআনের রঙে রাঙিয়ে দিন। সত্যিকারের কোরবানি করার তাওফিক আমাদের দিন। আমিন।

Related Articles

Back to top button