সম্পাদকীয়

প্রশাসনের তৎপরতার মধ্যেও জেলায় লকডাউন মানা হচ্ছে না, কঠোর হচ্ছে প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক
পেশায় টমটম চালক জিয়াবুল (২৭) খুরুশকুলের কুলিয়াপাড়ার বাসিন্দা। করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে নিজ ও পরিবারকে রক্ষা করতে গত ২৭ মার্চ থেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি ছিলেন। ভেবেছিলেন সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আর গাড়ি বের করবেন না। জমানো টাকা, সরকারি ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই কাটিয়ে দিবেন দুর্যোগকালীন সময়টুকু। কিন্তু ভাগ্য তার উল্টো। এতদিন সঞ্চয় থেকে ও ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন। ত্রাণের জন্য এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যানের কাছে তদবির করেও মিলেনি সহযোগিতা। ফলে নিরুপায় হয়ে বাড়ির সবার পেটের ক্ষুধা মেটাতে গত দুদিন থেকে টমটম চালাচ্ছেন জিয়া।
শহরের ভোলাবাবুর পেট্রলপাম্প এলাকায় ছোট একটি পান সিগারেটের দোকান করে সংসার চালান ফরিদ (৩২)। ছয় সদস্য নিয়ে ভাড়াবাড়িতে এ আয়েই থাকেন তিনি। সরকারি নির্দেশনায় গত ২৫ মার্চ থেকে দোকান বন্ধ। করোনার ভয়ে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হননি। জমানো টাকা, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করেই সংসার চালিয়েছেন এতদিন। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। তাই সংসারের খরচ মেটাতে দোকানের একাংশ খুলে বেচাকেনা করছেন গত কয়েকদিন ধরে। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে জিয়া, ফরিদের মত নানা পেশার লোকজন এখন লকডাউনের নিয়ম ভাঙতে শুরু করেছেন। এমনটি চলতে থাকলে জেলাবাসীকে এর মাশুল গুণতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে মানুষকে ঘরে রাখতে এবার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, করোনাভাইরাসের কারণে নিয়মিত প্রয়োজনীয় মালামাল, কাঁচামাল, মাছ এবং ওষুধের দোকান ছাড়া ২৫ মার্চ থেকে কক্সবাজারের সকল দোকানপাঠ বন্ধ। এর দুই একদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহনসহ ছোট বড় যানবাহন চলাচল। হাতে গোনা কয়েকটি রিকশা, টমটম চলাচল করলেও শহর জুড়ে নেমে আসে নীরবতা। জেলা প্রশাসন থেকে ঘোষণা আসে লকডাউনের। জেলাবাসীর মধ্যে দেখা দেয় স্বস্তি। তবে ত্রাণের সুষম বণ্টন না হওয়ায় অধিকাংশ লোকজনই ত্রাণ বঞ্চিত। ফলে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে ধীরে ধীরে জেলার নিম্নআয়ের মানুষেরা ঘরের বাইরে বের হতে শুরু করেছেন। চা, পান, সিগারেটের দোকান, বস্ত্র ও জুতার দোকান, মেট্রেসের দোকান, এমনকি কামারের দোকানও খুলতে শুরু করেছে। রাস্তায় বেড়েছে রিকশা, টমটম ও সিএনজি চলাচল। নির্মাণ শ্রমিকদের অনেকেই যোগ দিয়েছেন কাজে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় হাজারো মানুষের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। এ বিষয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া বলেন, ককক্সবাজারে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা হওয়ার পর থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৪৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনের শরীরে করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। তবে এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমাদেরকে আরও সর্তক হতে হবে। তিনি বলেন, দিনদিন দেখছি মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না। ছোট ছোট গণপরিবহন চলাচল করছে, রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল বেড়েছে। লোকজন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এটি জেলার জন্য হুমকি। ডা. অনুপম বড়ুয়া বলেন,, সত্যিকার অর্থে জেলায় লকডাউন মানা হচ্ছে না। আগামী ১৫ দিন কক্সবাজারের জন্য ভয়ংকর সময়। এই সময়টাতে যদি জনগনকে ঘরে রাখা না যায় তবে জেলায় মহামারির রূপ ধারন করতে পারে করোনাভাইরাস। আর জনগনকে যদি ঘরে রাখতে হয় তবে তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ঠদের বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, শুরুতে খুব কমসংখ্যক লোকজন বাইরে বের হত। কিন্তু ইদানিং লোকজন বাইরে আসছে। গতকাল আমি নিজেও শহর ঘুরে বিষয়টি খেয়াল করেছি। আমরা জনগনকে সতর্ক করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। তারপরও জনগণ আমাদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলছে। প্রশাসন দেখলে দোকান বন্ধ করে কিংবা গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। না হলে আশপাশের ভবনে ঢুকে যাচ্ছে। আবার আমরা সরলেই সব আগের মত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জনগণ যদি করোনা যুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা না করে তবে এর মাশুল সবাইকেই দিতে হবে। জনগনকে ঘরে রাখতে প্রচার প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি শুকনো খাবার, রান্না করা খাবার, নগদ টাকা, ও ত্রাণ সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায়ই ৭০ হাজার পরিবারকে ত্রাণ দিয়েছি। আমরা মধ্যবিত্তের তালিকা করেছি। সরকারের কাছে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। এত কিছুর পরও যদি জনগণ সচেতন না হয় তবে কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, জনগণকে ঘরে রাখতে আজ থেকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করা হবে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, কক্সবাজারবাসীর বিপদ দরজায় হাজির হয়েছে। সাত পদের তরকারি খেতে বাজারে যাওয়া, তুচ্ছ কারণে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করার অনুরোধ করছি আমরা। বেঁচে থাকলে অনেক প্রকার তরকারি খাওয়া যাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি মানে নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছেন। আমরা লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করবো। এই দুর্যোগের সময় কেউ আইনের মারপ্যাঁচে পড়ুক এটা আমরা চাই না।

Related Articles

Back to top button