ঈদগাঁওউখিয়াকক্সবাজারকক্সবাজার সদরকুতুবদিয়াচকোরিয়াটেকনাফপেকুয়ামহেশখালীরামুসারাদেশহোয়াইক্যং

রাজনীতি নিয়ে তৃণমূলে অনীহা-অসন্তোষ

কাউন্সিলে হয় না নেতা নির্বাচন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রান্তিক পর্যায়ে দলের জন্য যতই ত্যাগ কিংবা জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন, পদপদবী পেতে এখন এসব আগের মতো কাজে আসছে না। অনৈতিক লেনদেন, পরিচিতি বা ‘মাইম্যান’ হলে অনভিজ্ঞরাও দলের শাখা সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকের পদ পাচ্ছেন। আগের মতো কাউন্সিলে তৃণমূলের সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচন না হওয়ায় কর্মীদের কদরও কমছে। এসব কারণেই রাজনীতিতে মাঠের কর্মী হিসেবে দল গুছিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনে অনীহা প্রকাশ করছেন তৃণমূল কর্মীরা। পাশাপাশি এ নিয়ে আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার জেলায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অঙ্গ সংগঠনের জেলা ও একাধিক উপজেলায় সম্মেলন হলেও কাউন্সিল না করে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কমিটির কার্যক্রম কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে অসন্তোষ আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেওয়া কমিটি কেন্দ্রকে খুশি রাখতে নিত্য অভিনয় করলেও জেলা-উপজেলা কিংবা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুতে কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়ে না। ফলে পদ পাওয়ারা আখের গোছালেও উঠে আসছে না নতুন নেতৃত্ব। এমনটিই মনে করছেন সাবেক ছাত্র, যুব ও আওয়ামী লীগ নেতারা।
যুবলীগ ঃ
দলীয় সূত্র মতে, চলতি বছরের গত ৯ মার্চ কক্সবাজার পৌর যুবলীগের সম্মেলন সম্পন্ন হলেও শেষ করা যায়নি কাউন্সিল। পরের দিন ১০ মার্চ রামু উপজেলা যুবলীগের সম্মেলন হলেও সেখানেও হয়নি কাউন্সিল। ১১ মার্চ সম্মেলন হয়েছে কুতুবদিয়া উপজেলা যুবলীগের। আর ১২ মার্চ উখিয়া উপজেলা যুবলীগ এবং ১৩ মার্চ সম্মেলন হয় মহেশখালী উপজেলা যুবলীগের। কিন্তু কোথাও কাউন্সিল সম্পন্ন না হওয়ায় গঠিত হয়নি নতুন কমিটি। সম্মেলন শেষ করে নতুন কমিটি ঘোষণার দায়িত্ব কেন্দ্রে নিয়ে যান সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়া কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব শাখা সংগঠন থেকে নেতৃত্বকার্মীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) আহ্বানও করা হয়।
আরও জানা গেছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়ন নিয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা যুবলীগ পরিচালিত হলেও গতবছর ৫ ইউনিয়ন নিয়ে ঈদগাঁও উপজেলা গঠিত হয়। সেখানকার জন্য সিভি নেওয়া হয়। তবে কোনো নির্দেশনা আসেনি মেয়াদোত্তীর্ণ কক্সবাজার সদর উপজেলা কমিটির বিষয়ে। সদর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজিবুল হক রিকো ঈদগাঁওয়ের বাসিন্দা হিসেবে ঈদগাঁও উপজেলা আহ্বায়কের পদে সিভি দিয়েছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ সদর কমিটির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন পুতু অর্ধাংশ নিয়ে কার্যক্রমহীন রয়েছেন।
একইভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে ঢিমেতালে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে পেকুয়া, চকরিয়া, চকরিয়া পৌরসভা ও টেকনাফ উপজেলা যুবলীগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের একাধিক সাবেক নেতা-কর্মী বলেন, ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সর্বশেষ সম্মেলন ও কাউন্সিলে সোহেল আহমদ বাহাদুর সভাপতি ও শহীদুল হক সোহেল সাধারণ সম্পাদক হন। এ দু’জনই পাঁচ বছর পার করেছেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি। গোছাতে পারেননি কোনো ওয়ার্ড কমিটিও। ফলে তাদের পর নেতৃত্ব প্রত্যাশী কয়েকটি ব্যাচ ছিটকে গেছে। তবে নানা অনিয়ম, অভিযোগ এবং ব্যর্থতায় গত জুনের মাঝামাঝিতে ৫ বছর পর দুই সোহেলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্র। এরপর নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের সিভি জমা নিলেও এখনো পর্যন্ত আহ্বায়ক বা নতুন কোনো কমিটিও হয়নি। সকল কমিটির ঘোষণা কেন্দ্র নির্ভরতায় চলে যাওয়ায় চরম এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে জেলা ও উপজেলা যুবলীগ।
নেতা-কর্মীদের মতে, সদ্যবিলুপ্ত কমিটির সভাপতি সংগঠনকে ডুবিয়ে কর্মকান্ড চালাতেন উখিয়া-টেকনাফে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে উঠে আসা সোহেল আহমদ বাহাদুরের যুবলীগের জেলা সভাপতির পদ যেন ‘আলাদীনের চেরাগ’ হয়ে ধরা দেয়। এক সময় এনজিও সংস্থার কর্মজীবী বাহাদুর এখন অঢেল টাকার মালিক। প্রবাসে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে সৌদি আরবে পেট্রল পাম্প ও আবাসিক হোটেলে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে কয়েকটি কাভার্ডভ্যান, স্পিডবোট, টেকনাফ সড়কে চলাচল করা একাধিক পরিবহন, ফ্রেশ সিমেন্ট ডিলারশিপে বিনিয়োগসহ গ্রামের বাড়ি টেকনাফের কচুবুনিয়ায় বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছেন বলে প্রচার রয়েছে। অথচ সভাপতি হওয়ার আগে তার দৃশ্যমান তেমন কিছুই ছিল না। টেকনাফে বিগত উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থীর পক্ষে সরাসরি ভোট করার অভিযোগও রয়েছে বাহাদুরের বিরুদ্ধে। তার বাবা অ্যাডভোকেট নুর আহমদ একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে জাসদে যাওয়ার অভিযোগ আছে। এ কারণে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে এসে যুবলীগের দায়িত্ব পেয়ে দল গোছানোর পরিবর্তে আখের ঘুছিয়েছেন বলে অভিমত তাদের। তবে সকল অভিযোগ সত্যি নয়, এটি প্রতিহিংসা বলে দাবি করেছেন সোহেল আহমদ বাহাদুর।
অপরদিকে বাবা জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি মোজাম্মেল হকের ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে শহীদুল হক সোহেলও প্রসার ঘটিয়েছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের। কিন্তু সেভাবে সংগঠনের ভীত মজবুতে সক্ষম হননি। বলতে গেলে সভাপতি-সম্পাদক দু’জনই নিজেদের আখের গুছিয়ে ত্যাগী হাজারও নেতাকর্মীদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছেন। অবশ্য কক্সবাজার পৌর নির্বাচন ইস্যু নিয়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কার হন সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক সোহেল।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ ঃ
যুবলীগের মতো অবস্থা স্বেচ্ছাসেবক লীগের। গত বছরের ২৮ জুলাই জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন হলেও কাউন্সিল হয়নি। যুবলীগের পথ ধরেই কমিটির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রে নিয়ে যান নেতারা। সভাপতি-সম্পাদক পদে নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত নেওয়া হয়েছে সম্মেলন শেষে। এরপর থেকে পদ প্রত্যাশীরা ঢাকায় পড়ে রয়েছেন। একেক জন একেক নেতাকে ম্যানেজ করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। অনেকেই মোটা অংকের টাকায় পদ পেতে দর কষাকষি করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু দেড় মাসেও আলোর মুখ দেখেনি জেলা কমিটি।
ছাত্রলীগ ঃ
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জ্বীবিত হওয়ার প্রথম শিক্ষালয় হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের অবস্থাও কক্সবাজারে যাচ্ছেতাই। কনক-মনজুরের কমিটির পর কেন্দ্র থেকে সভাপতি-সম্পাদক হয়ে আসা আলী-তাহের কমিটি জেলার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়েছে। তাদের পর ইশতিয়াক-রাশেদ এবং চলমান সাদ্দাম-মারুফ কমিটিও তৃণমূলের নির্বাচিত নয়। ফলে পূর্বদের মতো বর্তমান জেলা সভাপতি-সম্পাদকও সংগঠন গোছানোর পরিবর্তে এলাকা ভিত্তিক নিজের স্লোগান দিতে ‘মাইম্যান’ সৃষ্টি এবং পড়ালেখা প্রসারের পরিবর্তে সব ধরনের ব্যবসায় নিজেদের ভাগের প্রসার ঘটাচ্ছেন। ফলে উঠে আসছে না মুজিব আদর্শের সত্যিকারের সৈনিক, এমন অভিমত সাবেক ছাত্র নেতা ও আওয়ামী লীগের বোদ্ধা মহলের। কেন্দ্র কর্তৃক কমিটি ঘোষণা ও পরবর্তীতে সংগঠন দুর্বল হওয়ার বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ থেকে উঠে আসা নেতৃত্বই আগামীতে মাদার সংগঠন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করে। এটি করতে অতীতে তৃণমূলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সুসংগঠিত করে নেতাকর্মীদের উজ্জ্বীবিত রাখা হতো। গণতান্ত্রিক চর্চায় সম্মেলন ও কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচন জরুরি। এতে নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় পদপ্রত্যাশীরা কর্মী সৃষ্টি ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতো। কিন্তু দল টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় এ ধারার ব্যত্যয় ঘটেছে তৃণমূলে।
আওয়মী লীগ নেতা রাশেদুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় হতেই কক্সবাজারে ছাত্রলীগ-যুবলীগের জৌলুস ছিল। কিন্তু বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে জেলা থেকে তৃণমূল কোথাও আগের মতো সুসংগঠিত নেই আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এমন অবস্থাও শুনি সভাপতি-সম্পাদক ছাড়া কমিটির অন্যরা একে অপরকেও চেনে না। নেই ‘চেইন অব কমান্ড’। কিন্তু যার কাছ থেকে কমিটি মিলবে সেই নেতাকে তোয়াজ করতে ভোলেন না কেউ।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক দায়িত্বশীল এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট রণজিত দাশ বলেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের জেলার দায়িত্বশীলদের স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিহিংসা, উচ্চবিলাসিতা ও অদক্ষতার কারণে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ত্যাগী হাজার হাজার নেতাকর্মী থাকলেও সংগঠনগুলো আজ এক প্রকার অস্তিত্ব সংকটে।
জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জেলা যুবলীগ তার অতীত জৌলুস হারিয়েছে। ছাত্রলীগের অভিজ্ঞ ও ত্যাগীরা পরবর্তীতে যুবলীগের দায়িত্বশীল হতো। কিন্তু গতবার ছাত্রলীগের কর্মীরা অবহেলিত হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ও যুবদল এমনকি ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা-কর্মীরাও যুবলীগের দায়িত্বশীলদের পেছনে সার্বক্ষণিক থেকে নিজেদের যুবলীগ কর্মী পরিচয় দিয়েছে। উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়েও এ চিত্র ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ঝিমিয়ে গেছে দলের পরিচিত কার্যক্রম। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে পুনরায় কাউন্সিলের মাধ্যমে তৃণমূলের সরাসরি ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত। আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, নানা কারণে অগোছালো হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠা কক্সবাজারের সাংগঠনিক কার্যক্রম গোছাতে উদ্যোগ চলছে। যুবলীগের নিবেদিত প্রাণ, ত্যাগী, আদর্শিক স্বচ্ছ ও সৎ নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে শিগগিরই নতুন কমিটি ঘোষণা হবে।
আওয়ামী লীগ ঃ
দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিও কেন্দ্র ঘোষিত হয়ে আসছে। সদ্য সাবেক হওয়া অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা-মুজিবুর রহমান কমিটি কেন্দ্রীয় সভাপতির নির্দেশনার কথা বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এছাড়া বর্তমান অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী-মুজিবুর রহমান কমিটিও বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের কথা বলে সভাপতি-সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। জেলা কমিটির সভাপতি-সম্পাদক কেন্দ্র নির্ধারিত হওয়ায় তৃণমূলে অসন্তোষ রয়েছে। কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় কেন্দ্র মনোনীতরাও উপজেলার নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই অনেক ত্যাগী আওয়ামী লীগের কর্মীরা এখন আগের মতো আর দলীয় কর্মসূচিতে সময় দেন না।

Related Articles

Back to top button