কক্সবাজারকক্সবাজার সদরসারাদেশ
Trending

পাচারকারীদের কাছেই দেখা যায় মহাবিপন্ন বনরুই

নিজস্ব প্রতিবেদক
একসময় কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকা সংলগ্ন তৃণভূমিতে দেখা যেত কয়েক প্রজাতির বনরুই বা খুদুক। কিন্তু এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ত্বক ও আঁশ বিভিন্ন ওষুধ তৈরির অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে অত্যধিক মূল্যবান হওয়ায় পাচারকারীদের টার্গেটে পড়ে প্রাণীটি। ফলে এখন এটি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে কম দেখা গেলেও মাঝেমধ্যে পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার হয় বনরুই। কালোবাজারে একেকটি বনরুইয়ের দাম প্রায় ২ লাখ টাকা বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার শহরের সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম সমিতিপাড়া থেকে একটি ‘দেশি বনরুই’ উদ্ধার করা হয়। বনরুইটি ‘ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন’ বা ‘দেশি বনরুই’ প্রজাতির বলে শনাক্ত করা হয়েছে। যেটি স্থানীয়ভাবে ‘খুদুক’ নামে পরিচিত। প্রায় চার মাস আগেও একই এলাকা থেকে একটি বনরুই উদ্ধার করে বনবিভাগ। প্রতিবন্ধী লোক দিয়ে বনরুইটি বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় বনকর্মীদের হাতে ধরা পড়ে।
গত জুলাই মাসে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থেকে উদ্ধার হয় বনরুই। এছাড়া গত বছরের ২৩ জুন চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন হামিদ মিয়ার বাড়ি থেকে দুটি বনরুইসহ পাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী থেকে এবং আগের বছর মে মাসে কুলাউড়া উপজেলার রাঙ্গিছড়ি চা বাগান থেকে ক্রেতা সেজে দুটি বনরুই উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। ২০২০ সালের মার্চে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় পাচারকারীদের হাত থেকে দুটি বনরুই উদ্ধার করা হয়।
সূত্র জানায়, একটি চক্র দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন প্রাণী সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে। বনরুই এশিয়া মহাদেশ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। পৃথিবীতে ৮ প্রজাতির বনরুই রয়েছে, তার মধ্যে এশিয়ায় ৪ প্রজাতির। এশিয়ায় বনরুইয়ের তিনটি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভশন অব নেচার (আইইউসিএন) এশিয়ার চারটি প্রজাতিকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ম্যানিস ক্র্যাসিকোডাটা বা দেশি বনরুই ও ফিলিপাইনের ম্যানিস কিওলায়নেন্সিসকে বিপন্ন এবং সুন্দারম্যানিস জাভানিকা ও চীনা একটি প্রজাতিকে অতি বিপন্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা অসিম মল্লিক জানান, বাংলাদেশের বনরুই পাচার হয় চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর ও মালোয়েশিয়ায়। মূলত এগুলো মাংস হিসেবে চীন ও জাপানে ব্যবহার হয়। এছাড়া বনরুইয়ের খোলসের আঁশ নামি দামি ব্র্যান্ডের জামা-কাপড়ের বোতাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কখনো গহনা হিসেবেও এর আঁশ ব্যবহার হয়। এজন্যই মূলত চড়া দামে বিক্রি হয় বনরুই।
প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, বনরুই একটি আঁশযুক্ত পিঁপড়াভোজী প্রাণী। ফোলিডোটা বর্গের যে আট প্রজাতির বর্ম-ঢাকা, দন্তহীন স্তান্যপায়ী প্রাণী রয়েছে বনরুই তার মধ্যে একটি। বনরুইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ প্যাঙ্গোলিন, যা মালয় ভাষা থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ দাঁড়ায় ঘূর্ণায়মান বস্তু, যা আত্মরক্ষার সময় নিজেকে বলের মতো কুঁকড়ে ফেলার অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে।
তথ্য মতে, একটি পূর্ণবয়স্ক বনরুই লম্বায় সাধারণত ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার (১-৩ ফুট)। এদের লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১০-২৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। মুখের দিক এবং শরীরের নিচের অংশ বাদে এদের পুরো শরীর সিমেন্টযুক্ত এক ধরনের চুলের সমন্বয়ে বাদামি আঁশ দিয়ে আচ্ছাদিত। এদের নাক সরু ও চোখা। জিভ লম্বা ও আঠালো, যা ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। নাকের মতো এদের চোখ ও কানও সরু। আশ্চর্যজনকভাবে বনরুইয়ের সামনের নখ পেছনের নখের তুলনায় দ্বিগুণ লম্বা। ওজন ৫ থেকে ২৭ কেজি (১০-৬০ পাউন্ড) পর্যন্ত হয়।
কিছু বনরুই যেমন আফ্রিকান কালো-পেটযুক্ত ম্যানিস লংগাইডাটা ও চীনা এম. পেন্টাড্যাকটায়লা গাছে বাস করে। আফ্রিকার বৃহদাকার এম. জিগান্তেয়াকে স্থলচর বনরুই হিসেবে দেখা যায়। বাকি বনরুইদের সবাই নিশাচর। দিনের বেলায় এরা গর্তে বাস করে। এরা সাঁতার কাটতেও সক্ষম। উইপোকা বনরুইয়ের প্রিয় খাবার হলেও পিঁপড়া এবং অন্য পোকামাকড়ও এরা ভক্ষণ করে। গন্ধ শুঁকে শিকার শনাক্ত করা এই প্রাণীটির সহজাত স্বভাব। বিপদকালীন পরিস্থিতিতে এরা প্রতিরক্ষার মাধ্যম হিসেবে মলদ্বার গ্রন্থি থেকে এক ধরনের তরল দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ নিঃসরণ করার পাশাপাশি শরীরকে কুঁকড়ে গোলাকার বলের মতো আকৃতি করে গড়িয়ে চলে। জানা যায়, সাধারণত প্রাণী হিসেবে বনরুই খুবই ভীতু স্বভাবের। এরা একা বা জোড়ায় বাস করে। বেশিরভাগ প্রজাতি প্রতি প্রসবে কেবল একটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে। তবে কিছু এশিয়ান প্রজাতিতে দুটি বা তিনটি পুরুষ সন্তানও জন্ম নিতে পারে। জন্মের সময় অল্প বয়স্ক বনরুইয়ের দেহাবরণ অত্যন্ত নরম থাকে এবং কিছু সময়ের জন্য মা বনরুইয়ের পিঠে চড়ে চলাফেরা করে। এদের গড় আয়ু নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে বন্দি অবস্থায় পর্যবেক্ষণকালে তাদের ২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে দেখা গেছে বলে অভিমত প্রাণী বিজ্ঞানীদের।

Related Articles

Back to top button